কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জনবল সংকট, দুর্নীতি এবং অনিয়মের কারণে চিকিৎসা সেবার ধারাবাহিকতা ধবংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। ৫০ শয্যার এই হাসপাতালটি শুধুই ভেড়ামারা না, পাশ্ববর্তী দৌলতপুর, মিরপুর ও ঈশ্বরদীর মানুষজনের জন্য একমাত্র আরোগ্য কেন্দ্র, যেখানে লাখো রোগী চিকিৎসা পাচ্ছেন। তবে চিকিৎসকদের অপ্রতুলতা, দুর্নীতিপরায়ণ দালালচক্র এবং কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে দীর্ঘ দিন ধরে এখানে চিকিৎসা সেবা অব্যাহত রাখতে হিমশিম খাচ্ছে রোগীরা। ডা. পলাশচন্দ্র দেবনাথের অবৈধভাবে বিদেশ গমন, হাসপাতালে দালালের অত্যাচার, সার্বিক অনিয়ম এবং দুর্নীতি একত্রে এই পরিস্থিতিকে আরো ভয়ঙ্কর করে তুলেছে। রোগীরা বলছেন, এ অবস্থায় যদি দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির জন্য নির্ধারিত ২৫ জন চিকিৎসকের মধ্যে শুধু একজন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, একজন জুনিয়র কনসালটেন্ট (সার্জারি), একজন মেডিকেল অফিসার ও কিছু অন্যান্য চিকিৎসক রয়েছেন। অপরদিকে, গাইনি, অ্যানেসথেসিয়া, শিশু, চক্ষু, কার্ডিওলজি, এনটিই, চর্ম ও যৌন রোগ বিশেষজ্ঞ নানা পদ শূন্য। আরও কিছু শূন্য পদে পদোন্নতি ও নিয়োগের জন্য চাপ নেওয়া হলেও সেখানে নিয়োগপ্রক্রিয়া চলমান নয়। ফলে, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতেও সব পদ খালি থাকায় সার্বিক স্বাস্থ্যসেবা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
অবস্থা এতই খারাপ, যে স্টাফ কম থাকার কারণে হাসপাতালের বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত মূল স্টাফের সংখ্যাও সীমিত। একজন মিডওয়াইফ, একজন জুনিয়র নার্স, অফিস স্টাফ, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট সহ মোট কর্মী সংখ্যাও বেশ কম। এর ফলে প্রতিদিনই অনেক রোগী সিটের বাইরে, বারান্দায় বা ফ্লোরে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হন। গাইনী ও অ্যানেসথেসিয়া বিভাগের ডাক্তার না থাকায় অস্ত্রোপচারের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। প্রতি দিন প্রায় ৪০০র বেশি রোগী আউটডোরে সেবা নিচ্ছেন।
এছাড়া, জরুরি বিভাগ, প্রসূতি সেবা, অপ্রতিষ্ঠানিক শুশ্রূষা ও জরুরি পরীক্ষার কোনও ব্যবস্থা এখন নেই। দীর্ঘদিন ধরে অদক্ষ স্টাফ ও নষ্ট হয়ে যাওয়া চিকিৎসা যন্ত্রপাতির কারণে প্রয়োজনীয় ল্যাব টেস্টও করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে রোগীরা বাধ্য হয়ে দূরবর্তী জেনারেল হাসপাতাল কিংবা বেসরকারি ক্লিনিকে যেতে হচ্ছে। সনোগ্রাফি ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে।
অভ্যন্তরীন পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে ডাক্তার ডা. পলাশ চন্দ্র দেবনাথের অনুপস্থিতি। জানা গেছে, তিনি ২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য ছুটি নিয়েছিলেন, কিন্তু দীর্ঘদিন আগে থেকেই আর ফিরছেন না। স্থানীয়রা বলছেন, তিনি সরকারি বেতন নিয়ে এভাবে অবৈধভাবে বিদেশে গেছেন, যা চিকিৎসা সেবায় বড় ক্ষতি। তার এই অনুপস্থিতির কারণে হাসপাতালের সংকট আরও गাঢ় হচ্ছে।
বিশেষ করে, দালালচক্র সক্রিয় হয়ে রোগীদের বিভিন্ন প্রাইভেট ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ঠেলে দিচ্ছে, যেখানে অনিয়মের মাধ্যমে রোগীদের অতিরিক্ত চার্জ ও ভোগান্তি বাড়ছে। হাসপাতালের ফটকের সামনে রয়েছে তিনটি প্রাইভেট ডায়াগনস্টিক সেন্টার, যেখানে অসাধু কার্যকলাপের জন্য অভিযোগ রয়েছে। রোগীরা ধরাধরি করে টেস্ট বা আলট্রাসাউন্ডের জন্য চাপ দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
এদিকে, জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের নির্দেশে কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মচারীর বদলি হওয়ায় পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক হয়ে পড়েছে। স্টাফ কম থাকার কারণে রোগীদের জন্য সার্বিক চিকিৎসা সেবা অনেকটাই অচল হয়ে পড়েছে। অন্য দিকে, আশেপাশের অঞ্চল দৌলতপুর, মিরপুর ও ঈশ্বরদীর মানুষও চিকিৎসা নিতে আসলেও, ডাক্তার ও পরীক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় তাদেরকেও বাধ্য হয়ে কুষ্টিয়া শহরের বড় হাসপাতাল বা বেসরকারি ক্লিনিকে যেতে হচ্ছে। এতে সময়, অর্থ এবং মানসিক কষ্ট অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।
ভেড়ামারা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মিজানুর রহমান বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটিতে চিকিৎসক সংকট প্রকট। আমরা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বিষয়টি জানিয়েছি এবং দ্রুত সমাধান করার চেষ্টা চলছে। ডা. দেবনাথের অনুপস্থিতি সত্যিই চিকিৎসা সেবায় বড় ক্ষতি বলে মনে করছি।’ স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম জানান, ‘হাসপাতালের দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তবে, চিকিৎসক সংকটটি এখন জাতিরই সমস্যা, যা সমাধানে সরকারের একযোগে উদ্যোগ দরকার।’