শুক্রবার, ২২শে আগস্ট, ২০২৫, ৭ই ভাদ্র, ১৪৩২

নতুন বিলের কারণে উত্তাল ভারতের সংসদ, বিরোধীদের কড়া প্রতিবাদ

ভারতের সংসদে সম্প্রতি উপস্থাপিত এক বিতর্কিত আইনের কারণে রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। এই নতুন বিলের মাধ্যমে এমন একটি প্রস্তাবনা আনা হয়েছে, যেখানে গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত এবং ৩০ দিনের বেশি সময় জেলে থাকাদের কেন্দ্র বা রাজ্যের শীর্ষস্থানীয় সরকারি কর্মকর্তাদের পদ থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অপসারণের বিধান রাখা হয়েছে। সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয় হলো, এর জন্য অপরাধের বিচার সম্পন্ন হওয়া বা দোষী সাব্যস্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই। একমাত্র গ্রেপ্তার ও জেলে থাকার ঘটনাই যথেষ্ট এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে। এই বিলের বিরুদ্ধে বিরোধীরা একে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের জন্য বিপজ্জনক ও অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ বলে মন্তব্য করেছেন। একদিকে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের নেতৃত্বে প্রস্তাবিত এই বিলটি ভারতের লোকসভায় পেশ হলে ব্যাপক প্রত্যাখ্যান ও উত্তেজনা দেখা দেয়। একই দিন, অমিত শাহ তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিল পেশ করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল প্রশাসন (সংশোধনী) বিল, সংবিধান (১৩০ তম সংশোধনী) বিল ও জম্মু ও কাশ্মীরের পুনর্বিন্যাসের সংশোধনী বিল। এই বিলগুলো মূলত সংবিধানে সংশোধনী আনার জন্য আনা হয়েছে, তবে বিরোধীরা একে কঠোর সমালোচনা করছে। প্রস্তাবিত বিলটি বলছে, যদি কোনও প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বা কোনো রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী গুরুতর অপরাধে ৩০ দিনের বেশি জেলে থাকেন, তাহলে তাঁকে রাষ্ট্রপতির বা রাজ্যপালের মাধ্যমে পদ থেকে সরানোর সেই ক্ষমতা থাকবে। এই প্রস্তাব পেশের সাথে সাথে সংসদে হৈচৈ শুরু হয়। তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদরা প্রতিবাদে ও হট্টগোল করেন, এমনকি তারাও বিলের কপি ছিঁড়ে অমিত শাহর দিকে ছুড়ে মারেন। একাধিক সাংসদ নিজেদের উত্তেজনা বোঝাতে অধিবেশন মুলতুবি করেন। এর পেছনে, জম্মু ও কাশ্মীরের অবস্থা ও তার স্বাতন্ত্র্য ফিরিয়ে দেওয়ার দাবির প্রসঙ্গও উঠে এসেছে। বিশেষ করে, ২০১৯ সালে জম্মু ও কাশ্মীর থেকে বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার ও অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরে থেকে স্থানীয় জনগণের এবং রাজনৈতিক মহলের দাবি রয়েছে যে, এই রাজ্যটি আবারও পূর্ণাঙ্গ রাজ্য হিসেবে ফিরে আসুক। এই বিষয়ে, জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ বলেছেন, এই সংসদ অধিবেশনে হয়তো কিছু ইতিবাচক দিক বেরোবে। তিনি বলেন, ‘আমরা অনেক দিন ধরে অপেক্ষা করছি। যদি সরকার সত্যিই রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে আনে, তবে এটি গণতন্ত্রের জন্য ও কাশ্মীরের জনগণের জন্য একটি বড় ইতিবাচক পদক্ষেপ হবে।’ অন্যদিকে, বিরোধী দলগুলো মনে করছে, এই বিল কার্যকর হলে কেন্দ্র সরকার বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলক মামলা চালিয়ে তাদের সরকারের বাইরে নিয়ে আসার স্বয়ংক্রিয় উপায় তৈরি করবে। এতে ভোটে নির্বাচিত নেতাদের বিচার ছাড়াই সরিয়ে দেওয়া যাবে, যা ভারতের সংবিধানের মূলনীতির বিরুদ্ধে। কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্রা বলেন, ‘আমি এই প্রস্তাবকে সম্পূর্ণরূপে স্বৈরাচারী এবং অগণতান্ত্রিক মনে করি। এটি দুর্নীতির বিরুদ্ধে নয়, বরং জনগণের উপর এক ধরনের দমননীতি। যদি বিরোধী কোনও মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে তাকে ৩০ দিনের জন্য গ্রেপ্তার করা হয়, তাহলে সে অটোমেটিকভাবে পদ হারাবেন? এটি সংবিধানের মূল কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক।’ আরও একজন বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ও কংগ্রেস নেতা অভিষেক মনু সিংভি বলেন, ‘বিজেপি বুঝতে পেরেছে তারা ভোটে হারের মুখোমুখি, তাই এখন বিরোধী নেতাদের দমন ও দমনক্ষমতা বাড়ানোর জন্য এই বিল আনা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সংস্থার মাধ্যমে বিরোধী নেতাদের গ্রেপ্তার করে, বিচার ছাড়াই তাদের পদচ্যুতি ঘটানো তথা ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে। যদি এই আইন কার্যকর হয়, তবে অনেকের ধারণা, বিরোধী নেতারা স্বাভাবিক বিভাগহীন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবেন।’ কেউ কেউ উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেছেন, যেমন ২০২৪ সালে কেজরিওয়ালকে মদের নীতি নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করে পাঁচ মাসের বেশি কারাগারে রাখা হয়েছিল, যদিও পরে তার বিরুদ্ধে কোনো দোষ প্রমাণ হয়নি। যদি তখন প্রস্তাবিত এই আইন কার্যকর থাকত, তাহলে তার সাত দিনের মধ্যে তিনি মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে পদত্যাগ করতেন। তেমনি, তামিলনাড়ুর ডিএমকের নেতা ও রাজ্যের মন্ত্রী ভি সেন্টিল বালাজিকে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করলে, মুখ্যমন্ত্রী স্টালিন তাকে দপ্তর থেকে সরিয়ে দেন। রাজ্যপাল তা চ্যালেঞ্জ করলে, বিষয়টি সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। প্রয়োজন হলে, চাপের মুখে, তিনি পদত্যাগ করেন। এই বিলের বিরুদ্ধাচরণে বিভিন্ন বিরোধী দল একযোগে অভিযোগ তুলেছে। আরএসপির সাংসদ এন কে প্রেমচন্দ্রন বলেন, ‘এটি বিজেপির পরিকল্পনা—বিরোধী দলগুলোকে দমন করে ক্ষমতা দখলের। কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলিকে ব্যবহার করে বিরোধীদের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলক মামলা চালানো হচ্ছে, আর এখন সেই কাজকে আইনি রূপ দেওয়ার প্রয়াস চলছে।’ অন্যদিকে, এআইএমআইএমের নেতা আসাদুদ্দিন ওয়েইসি বলেছেন, ‘বিজেপি দেশকে পুলিশ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাইছে, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ মডেল অনুসরণ করে যেখানে বিরোধী নেতারা জেলে থাকে বা দেশ ছেড়ে পালায়। কিন্তু আমাদের গণতন্ত্র এভাবে ভাঙা যাবে না। আমরা এই বিলের তীব্র বিরোধিতা করছি।’ আরজেডি নেতা সুধাকর সিং বলেন, ‘এটা ভারতের গণতন্ত্রের জন্য এক বিপজ্জনক মোড়। আজ বিরোধী নেতাদের জেলে পাঠানো হচ্ছে, কাল দেশের স্বাধীনতা ও নির্বাচনী সুষ্ঠতার জন্য বিপদ আসবে।’ অন্য পক্ষ, বিজেপি বলছে, এই বিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক কার্যকরী পদক্ষেপ। তারা দাবি করছে, দুর্নীতিতে অভিযুক্তরা যাতে প্রমাণ লোপাট বা প্রভাব বিস্তার করতে না পারে, তাই এই আইনের প্রয়োজনীয়তা। কর্নাটকের বিধায়ক অরবিন্দ বেল্লাড বলেন, ‘বিগত সময়ে অনেক মুখ্যমন্ত্রী জেলে থেকেও সরকার চালাতে চেয়েছেন। এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে কঠোর আইন দরকার। এই বিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের জিরো টলারেন্সের প্রতিফলন।’ বর্তমানে, ভারতের জনপ্রতিনিধিত্ব আইনে বলা হয়েছে, যদি কোনও সাংসদ বা বিধায়ক দোষী সাব্যস্ত হন যার শাস্তি দুই বছর বা তার বেশি, তবে তিনি পদ হারাবেন। কিন্তু মামলা চলাকালীন বা বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি পদে থাকতে পারবেন। প্রস্তাবিত নতুন আইনটি সেই বাধাটিকে তুলে ধরে এবং শুধুমাত্র গ্রেপ্তার ও ৩০ দিন জেলকালে পদচ্যুতি নিশ্চিত করার কথা বলছে। এই বিলের কারণে সংসদে ব্যাপক বিতর্ক চলছে এবং জনমত দ্বিধাবিভক্ত। এক দিকে, কঠোর সংগ্রামের পক্ষে যুক্তি, অন্যদিকে, বিচার ছাড়াই পদচ্যুতির ঝুঁকি নিয়ে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা।

পোস্টটি শেয়ার করুন