গত এক দশকে বাংলাদেশে সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা মারাত্মকভাবে বেড়েই চলছে। এই প্রবণতার পেছনে মূল কারণ হিসেবে আর্থিক অনিশ্চয়তা, পেশাগত চাপ, পারিবারিক টানাপোড়েন এবং মানসিক হতাশা উল্লেখ করা হয়েছে। সম্প্রতি প্রবীণ সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকারসহ বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ব্যক্তির আত্মহননের খবর সংবাদমাধ্যমে আলোচিত হয়েছে, যা এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতির চিত্র আরও স্পষ্ট করেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, হতাশাজনিত বিষণ্নতা বা মনোভাবের পরিবর্তনের জন্য এই ঘটনা ঘটে থাকে। তাই সাংবাদিকদের স্বাস্থ্যমূলক ও মানসিক কল্যাণে সরকারের সক্রিয় উদ্যোগ নেওয়া এখন অপরিহার্য।
বিভুরঞ্জন সরকার, যিনি ৭১ বছর বয়সে ‘আজকের পত্রিকা’তে কর্মরত ছিলেন, তার জীবনেও পেশাগত ও ব্যক্তিজীবনের নানা সংকট ছিল। তিনি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে কলাম লিখতেন। কর্মস্থলে যাওয়ার আগে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন, তবে আর ফিরে আসেন নি। তাঁর এই আত্মহননের পেছনে মূল কারণ হিসেবে পরিবারে অসুস্থতা, ছেলে ও মেয়ের উচ্চশিক্ষা ও চাকরির স্বচ্ছলতা না পাওয়া, বেতন বৃদ্ধির অভাব এবং অর্থের অভাবের অসহনীয় চাপকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
অতীতের মানসিক চাপ ও অনিশ্চয়তার কারণে সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। বিশেষ করে ২০১২ সালে বিখ্যাত সাংবাদিক মিনার মাহমুদের আত্মহত্যার ঘটনা বেশ কৌতুহলী ও দৃষ্টিভঙ্গির কারণ হয়েছে। মিনার মাহমুদ একসময় নাটকীয়ভাবে জীবন শেষ করেন, তার সঙ্গে পাওয়া চিঠি ও বিষদ পরিস্থিতি তাদের হতাশা বা ভবিষ্যত নিয়ে গভীর মনোভাব প্রকাশ করে। এরআগে, শহীদ বুদ্ধিজীবী সেলিনা পারভীনের ছেলে ব্যাংক কর্মকর্তা সুমন জাহিদ, ফটোসাংবাদিক শবনম শারমিনসহ আরও কিছু প্রখ্যাত ব্যক্তির আত্মহত্যার ঘটনা দেশের আলাপ-আলোচনায় আসে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, অর্পিতা কবির, রাহনুমা সারাহ, সোহানা তুলিসহ অনেক সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীর আত্মহত্যার খবর প্রকাশ পেয়েছে। এই শতাব্দীর জটিল পারিবারিক, অর্থনৈতিক ও মানসিক সংকটের মধ্য দিয়ে কাটছে তাদের জীবন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, হতাশা, পারিবারিক কলহ, চাকরির অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এ সব অনুভূতির জন্য আত্মহত্যা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ঘটনা গুলোর পেছনে মূলত মনোভাব ও মানসিক চাপের কারণ রয়েছে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আহমেদ হেলাল উল্লেখ করেন, হতাশা যখন বিষণ্নতায় রূপ নিতে শুরু করে, তখনই একজন ব্যক্তি আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তিনি বলেন, ‘‘অতীতে যেসব সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী আত্মহত্যা করেছেন তাদের অনেকে হতাশায় ভুগে এই পথ বেছে নিয়েছেন।’’ তিনি আরও জানান, পেশাগত বা ব্যক্তিগত সংকট, অর্থের অভাব, পারিবারিক অশান্তি—এসব নানা কারণ একযোগে এই প্রবণতা বাড়িয়ে তুলছে। তিনি বলেন, ‘‘মানুষ একমাত্র কারণের জন্য নয়, বিভিন্ন কারণে আত্মহত্যা করে।’’
অন্তর্দৃষ্টিতে, তিনি বলেন, ‘‘আত্মহত্যা সমাধান নয়। এটি অনেক সময় হতাশার ফলাফল। তবে যারা এই সিদ্ধান্ত নেন, তারা তাদের পরিবারের জন্য ঝুঁকি তৈরি করেন। তাই আশেপাশের মানুষের মনোভাব ও মানসিক সুস্থতার দিকে খেয়াল রাখা জরুরি।’’
এছাড়াও, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক খোরশেদ আলম মনে করেন, সাংবাদিকদের এই পরিস্থিতির পেছনে রাষ্ট্রের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘‘সাংবাদিকরা যখন প্রাতিষ্ঠানিক ও পারিপার্শ্বিক চাপের সম্মুখীন হন, তখন তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে। তাই, রাষ্ট্রের উচিত, পেশাদার সাংবাদিকদের মানসিক ও আর্থিক স্বাভাবিকতার জন্য সব ধরনের সহায়তা প্রদান করা। সম্পাদকীয় ও বেতন-ভাতার স্তর উন্নয়নে রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।’’ আমরা যেন সত্যিই সচেতন হই, এই সংকট মোকাবেলায় সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে নিরাপদ ভবিষ্যত গড়ে তুলতে।