ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল এবং মানবাধিকার ও মানবতার জন্য একটি ভয়ঙ্কর চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে। ইসরায়েলি বর্বরতার ফলে সেখানে প্রায় তিন লাখ দ্বিতীয়শো হাজার (৩২ হাজার) শিশু গভীর অপুষ্টির শিকার হচ্ছে। এই তথ্যটি আলজাজিরার এক প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে।
আলজাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজার স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে, গত শনিবার দুপুর তিনটার আগ পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় আরও আট শিশুর অপুষ্টিতে মৃত্যু হয়েছে। ইসরায়েলি আক্রমণের শুরু থেকে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তার জেরে প্রায় দুই বছরের মধ্যে গাজায় কমপক্ষে ২৮১ জন শিশু মৃত্যুবরণ করেছে, যার মধ্যে ১৪২ জনই শিশু।
অপুষ্টির শিকার শিশুদের দ্রুত চিকিৎসায় অন্তত ১০টি হাসপাতালে সহায়তা জরুরি বলে জানিয়েছেন গাজা শহরের আল-শিফা হাসপাতালের পরিচালক মোহাম্মদ আবু সালমিয়া ও নাসের মেডিকেল কমপ্লেক্সের শিশু হাসপাতালের পরিচালক আহমদ আল-ফারা। তারা জানান, শিশুসহ আহত রোগীদের সংখ্যাও ভয়ঙ্করভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং অপুষ্টি আজ গাজার সবচেয়ে বড় জনস্বাস্থ্য সমস্যায় পরিণত হয়েছে। আবু সালমিয়া বলেছিলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে ভর্তি ১২০টি শিশু তীব্র অপুষ্টির শিকার। এই সমস্যা দীর্ঘ মেয়াদে পুরো সমাজের জন্য ভয়ঙ্কর ফলাফল নিয়ে আসবে।’
গত শুক্রবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন (আইপিসি) জানায়, গাজা উপত্যকায় দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছে কমপক্ষে ৫ লাখ ১৪ হাজার মানুষ। এই দুর্ভিক্ষ আরও ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে কারণ দেরির কারণে খাবার ও জরুরি সেবা প্রবেশে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে।
তবে ইসরায়েল এই দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতার আসল কারণ অস্বীকার করে বলা হয়েছে, তাদের কোনও পরিকল্পনা বা নীতির সাথে এই পরিস্থিতির সম্পর্ক নেই। এর বিপরীতে জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এই দুর্ভিক্ষের জন্য ইসরায়েলের দায় স্বীকার করেছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এ পরিস্থিতিকে ‘মানবসৃষ্ট বিপর্যয়’ ও ‘ম humanitary ব্যর্থতা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক বলেছেন, গাজার দুর্ভিক্ষ ইসরায়েলি কর্মকাণ্ডের সরাসরি ফলাফল। তিনি আরও বলেন, ‘যেসব দেশ বা প্রভাবশালী শক্তি এই বিষয়টি বোঝে বা নীরব থাকে, তাদের উচিত এই বিভীষিকাময় পরিস্থিতি বদলাতে আরও সক্রিয় ভূমিকা নেওয়া।’
অন্যদিকে, ইসরায়েলের ওপর অতিরিক্ত নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য মাল্টিপল দেশ ও সংগঠনের সমর্থন না পাওয়ায় নেদারল্যান্ডসের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কাসপার ভেল্ডক্যাম্প পদত্যাগ করেছেন।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম মিডল ইস্ট আই জানিয়েছে, গাজা ও পশ্চিম তীরে ইসরায়েলপন্থী ভাষা ব্যবহারে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়ায় মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। তাঁর নাম শাহেদ ঘোরেইশি, যিনি সর্ম্পূণভাবে স্পষ্ট করে বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র গাজার জনগণের অভিযান বা তাদের স্থানান্তর সমর্থন করে না।
এদিকে, ইসরায়েলি হামলায় গাজা উপত্যকায় আরও কমপক্ষে ৬৩ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। পাশাপাশি গাজার বিভিন্ন এলাকায় ইসরায়েলি সেনাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে, যেখানে প্রায় এক লাখ জনসংখ্যা জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হওয়ার উপক্রম।
ভিডিওচিত্রে দেখা গেছে, গাজার সাবরা এলাকায় ইসরায়েলি ট্যাংক প্রবেশ করছে যা সামরিক অভিযান আরও বৃদ্ধি পাওয়ার ইঙ্গিত। সাবরা গাজা নগরীর অবরুদ্ধ জায়তুন এলাকাও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আল-আহলি হাসপাতালের সূত্র জানিয়েছে, এই অঞ্চলে সাম্প্রতিক বিমান হামলায় এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
সকাল বেলায় খান ইউনূসের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল আসদা এলাকায় বাস্তুচ্যুতদের জন্য তৈরি আশ্রয়কেন্দ্রে ইসরায়েলি গোলা বর্ষণে অন্তত ১৬ জন নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে ছয়জন শিশু।
অন্যদিকে, ইসরায়েলি হামলার কারণে আরও ২২ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। খাদ্য ও মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠী, যেখানে গুলিবর্ষণে অনেকের মৃত্যু ও আহত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে।
ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যমতে, গত ২৪ ঘণ্টায় অনাহারে আরও আটজনের মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে দুই শিশু রয়েছে। এ নিয়ে সামগ্রিক অঘটনে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৮১ জনে, এর মধ্যে ১১৪ জনই শিশু।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক মুনির আল-বুরশ জানিয়েছেন, ‘ক্ষুধা নিঃশব্দে মানুষের দেহকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, শিশুদের জীবন প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিচ্ছে ও হাসপাতাল-আশ্রয়কেন্দ্রগুলিকে শোকে ভরে তুলছে।’
অন্তর্জাতিক সংস্থা শুক্রবার গাজায় দুর্ভিক্ষের ঘোষণা দেয়, যা এই অঞ্চলের প্রথম। তারা জানায়, প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ ভয়ানক ক্ষুধার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে এবং এই পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হলে আরও ভয়াবহ হতে পারে। মহাসচিব গুতেরেস এই দুর্ভিক্ষকে ‘মানবসৃষ্ট দুর্যোগ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।