শনিবার, ১৪ই ডিসেম্বর, ২০২৪, ২৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১

শিক্ষাঋণ বেড়েছে আড়াই গুণের বেশি

শিক্ষা খাতে ব্যাংকগুলোর ঋণ দেওয়ার পরিমাণ বেড়েছে। গত বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে শিক্ষার জন্য দেওয়া ব্যাংকগুলোর পরিমাণ ছিল ৪৭৭ কোটি ৬১ লাখ টাকা, যা চলতি বছরের একই প্রান্তিক শেষে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২৪০ কোটি ৯৪ লাখ। এক বছরের ব্যবধানে শিক্ষায় ব্যাংকগুলোর দেওয়া ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ১৬০ শতাংশ বা আড়াই গুণের বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

দেশের মধ্যে উচ্চশিক্ষার জন্য বিভিন্ন ব্যাংক ঋণ দিয়ে থাকে। কোনো কোনো ব্যাংক শিক্ষা উপকরণ কেনার জন্যও ঋণসুবিধা দিয়ে থাকে। কেউ আবার ঋণ দেয় উচ্চশিক্ষার জন্য যারা বিদেশ যেতে চায়। শিক্ষাঋণের আকার ৫০ হাজার থেকে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। এটাও একধরনের ভোক্তাঋণ।

খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শিক্ষা বা শিক্ষার্থীদের জন্য দেওয়া ব্যাংকঋণের বড় অংশ নিয়ে থাকেন দেশের বাইরে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীরা। অভিভাবকের আয় ও লেনদেনের তথ্য যাচাই করে তবেই ব্যাংকগুলো এই ঋণ দেওয়া হয়। বর্তমানে দেশের বাইরে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় এ ধরনের ঋণের চাহিদা বাড়ছে।

গত বছরের অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ে জাতিসংঘ সংস্থা ইউনেস্কোর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন প্রায় ৫৩ হাজার শিক্ষার্থী। উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে এসব বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর পছন্দের শীর্ষে ছিল যুক্তরাষ্ট্র। গত এক বছরে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন সাড়ে ৮ হাজার শিক্ষার্থী। উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের পছন্দের অন্য উল্লেখযোগ্য দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে—যুক্তরাজ্য, কানাডা, মালয়েশিয়া, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়া। ব্যাংকাররা জানিয়েছে, শিক্ষার্থীদের বিদেশ গমন বাড়তে থাকায় ব্যাংকগুলোর শিক্ষাঋণ বিতরণ বেড়েছে।

ঋণ পেতে কঠিন শর্ত :তবে প্রকৃত চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীরা ব্যাংকের কঠিন শর্ত পূরণ করতে না পারায় শিক্ষাঋণ নিতে পারছেন না। অনেক দেশ উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের সুদমুক্ত শিক্ষাঋণ দেয় কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো ৯-১০ শতাংশ পর্যন্ত সুদ হার নেয়। উন্নত দেশগুলোতে, এই ধরনের ঋণ সরাসরি ছাত্রছাত্রীদের যোগ্যতা এবং ভবিষ্যতের চাকরির সম্ভাবনার বিপরীতে দেওয়া হয় কিন্তু বাংলাদেশে পরিস্থিতি ভিন্ন।

বাংলাদেশে ঋণের বেশির ভাগই পিতামাতার আয়ের ওপর নির্ভর করে। ছাত্রের যোগ্যতা এবং ভবিষ্যতের চাকরির সম্ভাবনার উপর নয়। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে জামানত বা একটি গ্যারান্টি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি অনেক সময় সঠিক চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থী খুঁজে পেতে বাধার সৃষ্টি করে। প্রায়শই, পিতামাতার আয় এ শর্ত পূরণ করতে পারে না। ফলে শিক্ষার্থীদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়। শিক্ষাঋণের যোগ্য হওয়ার জন্য অভিভাবকদের সাধারণত ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত মাসিক উপার্জন দেখাতে হয়; তবে বেশির ভাগ দরিদ্র ছাত্রদের জন্য এটি সবসময় সম্ভব হয় না।

ইত্তেফাকের সঙ্গে আলাপকালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে একটি বেসরকারি কলেজের ডিগ্রির শিক্ষার্থী রাসেল আহমেদ বলেন, ব্যাংকগুলো যে শিক্ষাঋণ দেয় বিষয়টি তিনি তার এক বন্ধুর কাছ থেকে জানতে  পারেন। কিন্তু তিনি খোঁজ নিয়ে দেখেছেন এ ঋণ পিতামাতার আয়ের ওপর ভিত্তি করে দেওয়া হয়। যেহেতু তার বাবার আয় সেই শর্ত পূরণে ব্যর্থ তাই তিনি ঋণের জন্য আবেদনও করতে পারেননি। উচ্চতর পড়াশোনার জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ পেয়ে পড়াশোনা শেষে টাকা পরিশোধ করতে পারলে খুব ভালো হতো বলে মনে করেন তিনি।

তবে ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, শিক্ষাঋণ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং অনিশ্চিত কারণ ব্যাংকগুলোর কাছে ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে টাকা ফেরত পাওয়ার তেমন নিশ্চিত কোনো উপায় নেই।

আরেকটি প্রতিবন্ধকতা হলো কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা। কারণ হিসেবে তারা বলছেন; বাংলাদেশের চাকরির বাজার অস্থির। কয়েক হাজার নতুন স্নাতক ডিগ্রিধারী প্রতি বছর চাকরির বাজারে প্রবেশ করে এবং তাদের সবাই চাকরির সুযোগ পায় না, যা ঝুঁকি তৈরি করে। চাকরি নিশ্চিত করার পরেও, অনেক দরিদ্র যুবকদের সময়মতো ঋণ পরিশোধ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এ কারণে ব্যাংকগুলো শিক্ষাঋণ দিতে অনীহা দেখায়।

একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও জানান, কিছু ব্যাংক শিক্ষার্থীদের শিক্ষাঋণ দেওয়া শুরু করলেও বিষয়টি এখনও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। তিনি বলেন, শিক্ষাঋণের ক্ষেত্রে কোনো বিশেষ সুবিধা নেই। এগুলো অন্যান্য ভোক্তা ঋণের মতো এবং সুদের হারও একই। তিনি আরও বলেন, কিছু ব্যাংক তাদের সিএসআর তহবিল থেকে উপবৃত্তি এবং বৃত্তি সুবিধা প্রদান করে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহায়তা করছে।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, একটি জাতীয় ছাত্রঋণ প্রকল্প পারে বর্তমান উচ্চ শিক্ষার পরিস্থিতি উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তন আনতে। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ঘানা, দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং সুইডেনের মতো দেশগুলোতে এই জাতীয় স্কিম রয়েছে। যা খুব সফল প্রমাণিত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র,অস্ট্রেলিয়া এবং কানাডার মতো উন্নত দেশগুলোতেও শিক্ষাঋণ অতি সাধারণ বিষয়। বাংলাদেশ এখনো এ জাতীয় ঋণ প্রকল্প চালু করেনি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেহেতু অনেক শিক্ষার্থী আর্থিক সংকটের কারণে উচ্চশিক্ষায় ভর্তি  হতে পারে না; তাই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসতে পারে। আর্থিক সমস্যার কারণে উচ্চশিক্ষা চালিয়ে যেতে না পারায় অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী ঝরে যাচ্ছে। সুদের হার কমানোর ওপর জোর দিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেন, ঋণ আরও সহজলভ্য করার জন্য ব্যাংকিং পদ্ধতি সহজ করা উচিত।

পোস্টটি শেয়ার করুন