ইরানের বিরুদ্ধে ইউরোপীয় শক্তিগুলোর মাধ্যমে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল করার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর এখন তেহরান কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। সম্ভাবনা রয়েছে, ইরান পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (এনপিটি) থেকে সরে যেতে পারে। এই পরিস্থিতিতে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ভবিষ্যৎ নিয়ে বিশ্লেষকরা নানা ধরনের আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। মালভূমি বিশ্লেষকদের মতে, মিডল ইস্ট আইয়ের কলামে উল্লেখ করা হয়েছে, কয়েক মাসের অচলাবস্থার পর সম্প্রতি ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানি (যা collectively ‘ই-থ্রি’ নামে পরিচিত) ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহালের জন্য প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এই তিন দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে, তারা কূটনৈতিক সমাধান বিরাজমান রাখতে চায় এবং এর জন্য তারা পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাবে। ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তি ও জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ২২৩১ নম্বর প্রস্তাব অনুযায়ী, যদি মনে হয় কোনো পক্ষ বড় ধরনের অঙ্গীকার ভেঙেছে, তবে তারা নিরাপত্তা পরিষদে বিষয়টি জানাতে পারবে। এরপর ‘স্ন্যাপব্যাক প্রক্রিয়া’ শুরু হবে, যার অর্থ হলো পুনরায় নানা ধরনের আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সমস্যা সমাধান না হলে ধাপে ধাপে ইরানের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞাগুলো পুনরায় কার্যকর হবে। এর মধ্যে রয়েছে তার অস্ত্র, ক্ষেপণাস্ত্র, জাহাজ চলাচল ও বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা। এই সিদ্ধান্ত ভেটো প্রতিরোধী, অর্থাৎ কোন দেশ এককভাবে এ পদক্ষেপ ঠেকাতে পারবে না। তবে ইরান বলছে, তারা দুই বড় শর্তে ঐ নিষেধাজ্ঞাগুলো এড়াতে পারে—অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা শুরু করা এবং আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) সাথে সহযোগিতা পুনরুদ্ধার। এতে অন্তর্ভুক্ত, ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলোর প্রবেশাধিকারعودة, বিশেষ করে সাম্প্রতিক সংঘর্ষের পরে বন্ধ হয়ে যাওয়া এই প্রবেশাধিকার, এবং ৬০ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের সম্পূর্ণ হিসাব দাখিলের বিষয়। সকল নিষেধাজ্ঞা ইরানের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হলেও, বিশেষ করে তিনটি নিষেধাজ্ঞা সবচেয়ে ভয়াবহ—তেল ও গ্যাস খাতে নতুন বিনিয়োগ নিষিদ্ধ, ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি) এর ওপর ব্যাপক বিধিনিষেধ এবং ১৬৯৬ নম্বর প্রস্তাবের পুনর্বহাল, যা ইরানকে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সম্পূর্ণ বন্ধ করতে বাধ্য করে। ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের মূল নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ইরানের আলোচনা বন্ধ হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে, ইরানের তেল ও গ্যাস খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ইরানের অর্থনীতির প্রাণশক্তি বলে স্বীকৃত এই খাতটির উৎপাদন কমে যাচ্ছে, প্রযুক্তি পুরাতন হয়ে পড়ছে, আর দেশীয় চাহিদাও দ্রুত বাড়ছে। উদাহরণস্বরূপ, সাউথ পার্স গ্যাসক্ষেত্র ইরানের বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রায় দুই তৃতীয়াংশের জ্বালানি দিচ্ছে। এই চাপ কমে যাওয়ায় বিদ্যুতের সংকটও বেড়েছে। ইরানের জ্বালানিমন্ত্রী বলছেন, পরবর্তী চার বছরে প্রতি বছর ১৯ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রয়োজন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে অন্য দেশগুলো ইরানে প্রবৃদ্ধিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। ফলে রাশিয়া ও চীনই একমাত্র এতে স্বচ্ছন্দে অর্থ বিনিয়োগ করতে পারে বলে ধারণা। তবে, আইআরজিসির ওপর দেশে কঠোর নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলে, তা ইরানের পুরো অর্থনৈতিক ভাঁওড়াকেও দুর্বল করবে। চীন ইরানের মোট তেলের প্রায় ৯০ শতাংশ কেনে, কিন্তু আইআরজিসি দেশটির তেল বাজারের প্রায় অর্ধেকের নিয়ন্ত্রণ করে। একতরফা নিষেধাজ্ঞা বলবৎ হলে, চীন হয়তো নামমাত্র কেনাকাটা কমাতে বা বন্ধ করতে পারে। রয়টার্সের ন্যugas অনুযায়ী, আইআরজিসি প্রায় ৫০ শতাংশ তেল বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে। এই নিষেধাজ্ঞাগুলোর ফলে মূল্যস্ফীতি বাড়বে, রিজার্ভ কমবে, এবং রিয়াল আরও অবমূল্যায়িত হবে। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা আরো আরও ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে, আর এর ফলে দেশজুড়ে অস্থিরতা ও অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও রয়েছে। রাজনৈতিক দিক থেকেও ক্ষতি বয়ে আনছে এই নিষেধাজ্ঞাগুলো—আইআরজিসি আন্তর্জাতিকভাবে আরও একঘরে হবে। অনেক দেশ তাদের ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে ঘোষণা করতে পারে। সর্বনাশা হিসেবে দেখা হচ্ছে ২০০৬ সালে গৃহীত ১৬৯৬ নম্বর প্রস্তাব—যার মধ্যে ইরানকে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ও পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ পুরোপুরি বন্ধ করতে বলা হয়। এতে গবেষণা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও অন্তর্ভুক্ত। ইরান বারবার দাবি করেছে, তারা পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি (এনপিটি)-এর অধিকার অনুসারে এই কার্যক্রম চালিয়ে যাবে। এর ফলে, ২০১১ থেকে ২০২৩ সালে অতিক্রান্ত সময়ের সামগ্রিক ক্ষতি প্রায় ১.২ ট্রিলিয়ন ডলার (প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার কোটি ডলার), সাথে সাথে অভ্যন্তরীণ জনমতের ক্ষোভ ও বিক্ষোভও বেড়েছে। একদিকে, প্রয়োগ এবং চাপের কারণে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি অন্ধকারে চলে গেছে, অন্যদিকে, তার পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার ওপর কঠোর উত্তরাধিকারের ঝুঁকি আরও বেড়ে গেছে। তবে, এই পরিস্থিতি এড়িয়ে যেতে চাইলে, একমাত্র সমাধান হচ্ছে ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বন্ধ করে দেয়াই—যা মূল সংকটের কেন্দ্রবিন্দু। এর সঙ্গে একজন বিশ্লেষক বলেছেন, ‘একটাই সমাধান—ইরানের সমৃদ্ধকরণের অধিকার স্বীকৃতি দেওয়া। তবে তা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য, যতদিন সবাই মানবে।’ ইরান ও পশ্চিমা শক্তিগুলোর মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী সমঝোতা ছাড়া এই সংকটের সমাধান কঠিন বলে মনে করছে বিশ্লেষকরা।
