বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দীর্ঘ প্রায় দুই দশক পর প্রথমবারের মতো গণমাধ্যমে মুখোমুখি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এই বিস্তৃত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, শীঘ্রই তিনি তার দেশে ফিরে আসবেন এবং আগামী নির্বাচনে অংশ নেবেন। একইসঙ্গে তিনি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, দলের কৌশল এবং সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ওপর তার দলের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন।
সাক্ষাৎকারের শুরুতে তিনি বলেছেন, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য তিনি এবং তাঁর দল কঠোর পরিশ্রম করছে। তাঁর লক্ষ্য, একটি প্রতিযোগিতামূলক, নীতিনিষ্ঠ ও ভদ্রতার ভিত্তিতে পরিচালিত নির্বাচনের মাধ্যমে পরিবর্তন আনা। তিনি আরও বলেন, জনগণের আস্থা ফিরে পেতে হলে রাজনীতিতে ঘৃণা নয়, সহযোগিতা ও দেশপ্রেমকে প্রাধান্য দিতে হবে।
তারেক রহমান জানিয়েছেন, তার ফিরে আসার ইচ্ছে ও আগ্রহের ব্যাপারটি শেষ হয়নি। তাঁর ভাষ্য, ‘আমি চেষ্টা করছি, আগ্রহ দেখাচ্ছি, যেখানে প্রত্যাশিত নির্বাচন হবে, সেখানে আমি জনগণের সঙ্গে থাকব। কিছু কারণে এখনো ফিরে আসতে পারিনি, তবে মনে হয়, সময় হয়ে এসেছে। খুব শিগগির ফিরে আসবো।’ তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচনের সঙ্গে রাজনৈতিক দল ও কর্মীর গভীর সম্পর্ক রয়েছে। যেখানে প্রত্যাশিত, জনগণের আকাঙ্ক্ষিত নির্বাচন হবে, আমি সেখানে থাকব।’
তিনি উল্লেখ করেন, তার শারীরিক উপস্থিতি যুক্তরাজ্যে হলেও তিনি মন ও মানসিকভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে রয়েছেন। ‘আমি গত ১৭ বছর ধরে বাংলাদেশইে রয়ে গিয়েছি। আমার মন, মানসিকতা এবং সমস্ত কিছুই সেই দেশের সঙ্গে জড়িত,’—বলেন তিনি। নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে যখন প্রশ্ন করা হয়, তখন তিনি আশ্বাস দেন, ‘ইনশাআল্লাহ, আমি অংশগ্রহণ করব।’
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার বিষয়ে তার বক্তব্য, ‘সেটি আমার সিদ্ধান্ত নয়, সেটি তো বাংলাদেশের জনগণই ঠিক করবে।’
নির্বাচনের জন্য বিএনপির মনোনয়ন প্রক্রিয়া ও কৌশল সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমরা কখনোই পেশিশক্তি বা টাকার প্রভাবের ভিত্তিতে প্রার্থী মনোনয়ন দিইনি এবং ভবিষ্যতেও দেব না। আমাদের মূল معيار হলো, প্রার্থীর এলাকার সমস্যা বোঝা, মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ ও জনস্বার্থে কাজের ক্ষমতা। আমরা চাই এমন একজন প্রার্থী, যার সঙ্গে তার এলাকার সব শ্রেণির মানুষ—তরুণ, নারী, বৃদ্ধ, ছাত্র—সহজে যোগাযোগ করতে পারে এবং যাঁর প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ও সমর্থন রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘তৃণমূলের মতামত আলাদাও গুরুত্ব পায়। গণতন্ত্রে বিভিন্ন মত প্রকাশের স্বাভাবিকতা আমরা মানি। যেখানে বেশির ভাগের মতামত বড় আকারে পাওয়া যায়, সেটাই আমরা গুরুত্ব দিয়ে থাকি। তবে আমরা এমন একজন নেতাকে নির্বাচন করি, যে অঙ্গীকার করে পরিবেশের অধিকাংশ মানুষের সমর্থন পান এবং সেই অনুযায়ী কাজ করতে পারেন।’
গণমাধ্যমের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কথা বলতে না পারার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘এটি কোনোভাবেই এই নয় যে আমি কথা বলিনি। আমি এখানে আছি, বাংলাদেশে। আমার সামাজিক মাধ্যমসহ নানা পন্থায় যোগাযোগের চেষ্টা করেছি এবং আমি মনে করি আমি পৌঁছে গেছি সাধারণ মানুষের কাছে। স্বৈরাচারী সরকারের সময় আমার কথার অধিকারও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু আমি থেমে থাকিনি।’
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে হাইকোর্ট তার বক্তব্য ছাপানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তবে, গত বছরের আগস্টে হাইকোর্ট এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। তারেক রহমান ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন নিয়ে বলেন, তিনি তার ছোট ভাই ও সুস্থ মাকে রেখে এসেছেন। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সব কিছু ভেঙে গেছে, পরিবারের অনেক সদস্যই নির্যাতনের শিকার। তিনি বলেন, ‘আমার পরিবারের যে কাহিনী আমি তুলে ধরছি, সেটি শুধু আমার না, হাজারো পরিবারের গল্প। যারা তাদের প্রিয়জন হারিয়েছেন, নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তাদের জন্য এই অন্যায়ের বিচার হওয়া উচিত। এটি কোনো প্রতিশোধের বিষয় নয়, বরং ন্যায়ের ডাক। আইনের মাধ্যমে অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া অবশ্যই কর্তব্য।’
সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন করা হয়, রাজনৈতিক দলগুলো নিষিদ্ধ হওয়া উচিত কি না। এর উত্তরে তিনি বলেছেন, ‘যদি কোনো দল বা নেতা অন্যায় করে থাকেন, তাহলে তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে। বিচার হবে। তবে, দল হিসেবে বা ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, দেশের আইনই সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে। যেসব অপরাধী জেল বা বিচারে ধরা পড়বেন, তারা তাদের শাস্তি পাবে।’
আওয়ামী লীগ কি বাংলাদেশের রাজনীতিতে থাকা উচিত—এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমার বিশ্বাস, আমরা জনগণের জন্যই রাজনীতি করি। যারা দেশপ্রেমে বিশ্বাস করে, তারা দেশ ও জনগণের উপকারে কাজ করে। যারা মানুষ হত্যা, গুম, লুটপাট করে, তাদের মানুষজন সমর্থন করে না। তাই, জনগণের ভোটে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, রাজনৈতিক দল ও নেতা নিজের পরিচয় ও কার্যকলাপের মাধ্যমে বিচার পায়।’
জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক সম্পর্কে প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আইন এবং দেশের নিয়ম অনুযায়ী যারা রাজনীতি করে, সবকারই তাদের অধিকার আছে। বিএনপি সবসময় বহুদলীয় রাজনীতিতে বিশ্বাস করে। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আগের সম্পর্ক থাকলেও, তা যেন স্বচ্ছভাবে ও আইনের আওতায় থাকে, আমরা সেটি মানি। পুরনো সম্পর্ক বা ঐতিহ্যকে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, মূলত দেশের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার জন্য দরকার।’
অতীতে জামায়াতে ইসলামের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক নিয়ে নানা আলোচনা থাকলেও, তিনি স্পষ্ট করেন, সংবিধান ও দেশের নিয়ম মেনে সকল দলই তাদের কার্যক্রম চালাতে পারে। তিনি বলেন, ‘আমরা এখন মূল লক্ষ্য, স্বৈরশাসনের অবসান এবং গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে সবার জন্য রাজনীতি করার অধিকার, সেটা সকলের জন্য খোলা।’
সবশেষে, জুলাই-আগস্টের গণআন্দোলনের বিষয়ে প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি কখনোই নিজেকে সেই আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে দেখি না। এই আন্দোলন ছিল বাংলাদেশের জনগণের। এই গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সব শ্রেণির মানুষ অংশ নিয়েছিল। এটি কোনো এক ব্যক্তির বা দলের একক কাজ নয়। বরং, এটি বাংলাদেশের বীর জনগণের সম্মিলিত উদ্যোগ, যারা গণতন্ত্রের জন্য বুক দিচ্ছেন।’