ফিলিস্তিনের বিধ্বস্ত গাজা শহরে যুদ্ধবিরতি বজায় রাখা এবং শান্তি পরিকল্পনার পরবর্তী ধাপ এগিয়ে নেওয়ার পথে সবচেয়ে বড় অন্তরঙ্গ বাধা হলো ইসরায়েল দ্বারা তৈরি করা ‘কৃত্রিম বাধা’। কাতারের হামাদ বিন খলিফা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুলতান বারাকাত এ বিষয়ে জাজিরাকে বলেন, একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে তিনি জানান, ইসরায়েলিরা প্রথম থেকেই তাদের বাহিনী প্রত্যাহার করা উচিত ছিল, তবে তারা চুক্তির শর্ত অনুযায়ী তা করেনি। বরং সাহায্য প্রবেশের অনুমতি দিলেও ধীরে ধীরে এটিকে বিলম্বিত করার চেষ্টা করছে এবং আশা করছে, এতে একটি সংকট সৃষ্টি হবে যাতে হামাস কোনও না কোনও ভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে বাধ্য হবে। অধ্যাপক সুলতান বারাকাত আরও বলেন, পশ্চিম তীরকে সংযুক্ত করতে ইসরায়েলির উদ্যোগগুলো মূলত ট্রাম্প প্রশাসনের উদ্যোগের প্রতিফলন, যা এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা বিঘ্ন করতে চায়। ৯ অক্টোবর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেন যে, ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই চুক্তির মধ্যে প্রথম ধাপে সব বন্দি মুক্তি এবং ইসরায়েলি সেনাদের প্রত্যাহার নিশ্চিত করা হয়। ১০ অক্টোবর সকাল ৯টার মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও তারপর থেকেই ইসরায়েলের বিরোধীরা বারবার এই চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলছে। অন্যদিকে, যুদ্ধবিরতি কার্যকর থাকলেও ইসরায়েল বিদেশি সাংবাদিকদের গাজায় প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছে না। ফলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের জন্য গাজা থেকে সরাসরি খবর সংগ্রহের কাজ অনেকটা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এটি একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ধারণা, যাদের মূল লক্ষ্য গোপন রাখা এবং যুদ্ধাপরাধের সত্যতা আড়াল করা। বৃহস্পতিবার জেরুজালেমের সর্বোচ্চ আদালতে বিদেশি সাংবাদিকদের সংগঠন ফরেন প্রেস অ্যাসোসিয়েশন (এফপিএ)-এর দায়ের করা মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এই সংগঠনের পক্ষে তারা গাজায় সাংবাদিকদের প্রবেশের অনুমতি চেয়েছিল, কিন্তু ইসরায়েলি সরকার তাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাতে আরও ৩০ দিন সময় চেয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করে বলেছে, এটি সত্য তথ্য গোপনের চেষ্টা এবং যুদ্ধাপরাধের আড়াল করতে দিন দিন সাংবাদিক প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করছে। এফপিএ বলছে, ইসরায়েল ইচ্ছাকৃতভাবে সময়ক্ষেপণ করছে যাতে সাংবাদিকদের গাজায় প্রবেশের কাজ দেরি হয়। গাজার পরিস্থিতি এতটাই কঠিন যে বিদেশি সাংবাদিকরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সীমিত এলাকায় কাজ করতে পারছেন। অন্যদিকে, প্রাণের ঝুঁকি নিয়েও ফিলিস্তিনি সাংবাদিকরা এখন গাজা থেকে খবর পাঠাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলি হামলায় ২০০ জনের বেশি সাংবাদিক প্রাণ হারিয়েছেন, যা এক বিবরণে ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাণঘাতী সংঘাত হিসেবে পরিগণিত। হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির অংশ হিসেবে ইসরায়েল গাজা থেকে ২৫০ জন দণ্ডিত ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দিয়েছে, যার মধ্যে অনেককে মাসখানেক ধরে আটক করে রাখা হয়েছিল। এই বন্দিরা অপ্রকাশিত বা অপ্রস্তুত অভিযোগ ছাড়াই কারাগারে ছিল এবং অনেকের উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের অভিযোগ, ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় নির্বিচারে অভিযান চালিয়ে সাধারণ মানুষকে ধরে নিয়ে যায়, যেখানে কিছু লোকের কোনও সন্ত্রাসী সম্পর্ক ছিল না। ইসরায়েলের দাবি, আটক সবাই সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত, কিন্তু অনেক মানবাধিকার সংস্থা ও জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অধিকাংশ মানুষ কোনও সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত নয়। আটক ব্যক্তিরা সাধারণত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। ৭ অক্টোবর হামাসের ইসরায়েল আক্রমণের পর থেকে, গাজায় হাজার হাজার মানুষ আহত ও নিহত হয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, এই সময়ে ৬৮,২০০ এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত এবং ১৭ লক্ষের বেশি আহত হয়েছে। একই সময়ে, দখলকৃত পশ্চিম তীরে সহিংসতা বেড়েছে; সেখানে কমপক্ষে এক হাজার ৫৬ জন নিহত ও ১০ হাজার ৩০০ জন আহত হয়েছে। হামাসের সঙ্গে যুদ্ধের সময়ে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গাজা থেকে অসংখ্য মানুষকে আটক করেছে। ২০২২ সালের অবৈধ যোদ্ধাদের আটক আইন অনুযায়ী, ইসরায়েলি বাহিনী গাজার বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষকে আটক করে বিভিন্ন কারাগারে রাখছে। তাদের অনেকের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ বা বিচার হয়নি, তাদের অধিকাংশই নিঃসঙ্গভাবে কারাগারে বন্দি। অনেক মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দি জানান, কারাগারে তাদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হতো। তারা বলছেন, নিয়মিত মারধর, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, পর্যাপ্ত খাবার না দেওয়া ও মানসিক নির্যাতনের শিকার তারা। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পরপরই শুরু হয় ইসরায়েলি দমন-পীড়ন, যেখানে হাজার হাজার গাজাবাসী আটক করা হয়। এই সব আটক ব্যক্তি অনেক পরে নিজস্ব অভিযোগ বা বিচার ছাড়াই আটক রেখে দেওয়া হয়। অধীনে আইনি নিয়মনীতি না মানার কারণে, অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগও আনেনি ইসরায়েলিরা। আকর্ষণীয়ভাবে, অনেক আটক ব্যক্তি মিডিয়ার নজর এড়াতে বা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন থেকে রেহাই পেতে চাচ্ছেন। জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনে দেখা গেছে, অনেক আটক ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ এমনকি আদালতে তোলা হয়নি, শুধু নির্বিচারে গ্রেপ্তার করা হয়। গাজার পরিস্থিতি এতটাই জটিল ও উদ্বেগজনক যে সেখানে প্রবেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ একচেটিয়াভাবে হাতে রেখেছে ইসরায়েল। দুই বছর ধরে চলা এই সংঘাতে বহু সাধারণ নাগরিক সেই সীমিত সুযোগ নিয়েই গাজায় প্রবেশ করেছেন। এখনও, প্রাণের ঝুঁকি নিয়েই স্থানীয় ফিলিস্তিনি সাংবাদিকরা তাদের খবর পৌঁছানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, কারণ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, এই সময়ে শত শত সাংবাদিক হামলায় নিহত হয়েছেন। ২০২৩ সালের শুরু থেকেই গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতা চলছেই,আর এই সংঘাতে এখন পর্যন্ত দাজা হাজারের বেশি মানুষের জীবন ঝুঁকিতে রয়েছে।





