বুধবার, ৫ই নভেম্বর, ২০২৫, ২০শে কার্তিক, ১৪৩২

পদ্মার দুর্গম চরে সক্রিয় চরমপন্থী সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো

কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার পদ্মা নদীর দুর্গম চরাঞ্চল ও ভারতের সীমান্তঘেঁষা এলাকাগুলো দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন অপরাধের অস্থায়ী আশ্রয়স্থল হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি এখানে জমি দখলকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ও ঘণ্টাব্যাপী গোলাগুলির মধ্যে তিনজন নিহতের ঘটনা ঘটেছে, যা পুলিশের চিন্তার খোরাক রেখেছে। তবে এসব ঘটনায় প্রশাসন এখনো সুচারুভাবে কিছু করতে পারেনি। জানা গেছে, এই চরাঞ্চলে শুধু কাকন বা মণ্ডল বাহিনী নয়, সাইদ, রাখি, কাইগি, রাজ্জাক ও বাহান্ন বাহিনীর মতো গুপ্ত বাহিনীও সক্রিয়ভাবে কাজ করছে।

এ সব বাহিনী বিভিন্ন রাজনৈতিক আশ্রয়ে জমি দখল, ফসল কেটে নেওয়া, চাঁদাবাজি, বালু উত্তোলন, মাদক ও অস্ত্র পাচারসহ নানা ধরনের অপরাধে জড়িত। স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলছেন, পদ্মার এই দুর্গম চরে তারা বেশিরভাগ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে, ফলে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার ঘটেছে। কুষ্টিয়া, রাজশাহী, নাটোর ও পাবনা জেলার এই চরাঞ্চলে বাহিনীগুলোর উপস্থিতি অনেকদিন ধরেই বিস্তৃত।

সম্প্রতি, দৌলতপুরের পদ্মা চরাঞ্চলে কাকন বাহিনী ও মণ্ডল গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে তিনজন নিহত হয়েছে। এই ঘটনার পর, প্রশাসন দ্রুত কার্যক্রমে নেমে আসে। এ ঘটনায় কাকন বাহিনীর প্রধান কাকনকে প্রধান আসামি করে মামলা দায়ের হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জেলা পুলিশের বেশ কয়েকটি ইউনিট দ্বারা শতাধিক সদস্যের সমন্বয়ে চিরুনি অভিযান চালানো হয়, তবে প্রথম দিন কাউকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। তবে, জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, অভিযান অব্যাহত থাকবে।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এই চরাঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে দুষ্কৃতকারী গ্রুপগুলো সক্রিয় রয়েছে। দুই যুগ আগে দুটি সন্ত্রাসী গ্রুপের উত্থান ঘটে, যাদের মধ্যে ‘পান্না বাহিনী’ ও ‘লালচাঁদ বাহিনী’ ছিল শীর্ষস্থানীয়। এই দুই বাহিনী নিয়মিত অপরাধের সাথে যুক্ত ছিল এবং বেশ কয়েকজন নিহত হয়। সেই সময় এই এলাকায় প্রবেশ মানা হতাশাজনক ছিল, কারণ দ্বন্দ্বের কারণে জীবন ঝুঁকিতে থাকত মানুষ।

সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত কাকন বাহিনীর বিরুদ্ধে ঈশ্বরদী, বাঘা, লালপুর ও দৌলতপুর থানায় মোট ছয়টি মামলা দায়ের হয়। বাহিনীর প্রধান কাকন পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার বাসিন্দা হলেও, তার পৈতৃক বাড়ি কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের মরিচা ইউনিয়নের মাজদিয়াড় গ্রামে। ১৯৯৪ সালে বিএসসি ডিগ্রি নিয়ে তিনি নিজ উচ্চশিক্ষা জীবন শুরু করেন, কিন্তু ২০০৫ সালে পান্না বাহিনীর নেতা নিহতের পরে তিনি সৌদি আরব থেকে ফিরে আসেন এবং আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের আশ্রয়ে আসেন। এর পর থেকে তিনি নিজের সন্ত্রাসী বাহিনী গঠন করেন, যার সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ৪০ বলে জানা গেছে।

গত বছর, সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে, দৌলতপুরের ফিলিপনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নইম উদ্দিন সেন্টুকে তার কার্যালয়ে গুলি করে হত্যার ঘটনাও এই বাহিনীর ছত্রছায়ায় ঘটেছিল। এই ঘটনায় অভিযুক্ত টুকু বাহিনীর প্রধান তরিকুল ইসলাম ওরফে টুকু, যার দলের সদস্য সংখ্যা ২০ এর বেশি। হত্যাকাণ্ডের পর, তার বিরুদ্ধে মামলা হলেও, পরে তিনি জামিনে মুক্তি পান।

চলতি বছর, ফেব্রুয়ারির শুরুতে, মরিচা ইউনিয়নের বৈরাগীরচর মণ্ডলপাড়া এলাকায় রাজু আহমেদ (১৮) নামের এক যুবককে গুলি করে হত্যা করা হয়, যেখানে সাইদ বাহিনীর প্রধান আবু সাঈদ মণ্ডল ছিল অভিযুক্ত। তার বিরুদ্ধে দৌলতপুর থানায় বেশ কয়েকটি মামলা দায়ের হয়েছে।

অপরদিকে, ‘রাখি বাহিনী’ এর প্রধান রাকিবুল ইসলাম রাখি, যিনি ফিলিপনগর ইউনিয়নের দারোগার মোড়ে বাস করেন, তার বিরুদ্ধে সাতটি মামলা রয়েছে। পাশাপাশি কাইগি, রাজ্জাক ও বাহান্ন বাহিনীও সক্রিয়ভাবে কাজ করছে এ এলাকায়।

আনুমানিকভাবে, অগাস্টের প্রথম দিকে দৌলতপুর সীমান্ত দিয়ে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র বাংলাদেশে প্রবেশের খবর পাওয়া গেছে। জানা গেছে, তিনটি চালানে মোট প্রায় ২ হাজারের বেশি আগ্নেয়াস্ত্র আসতে পারে।

বৃহস্পতিবার, কুষ্টিয়া জেলা পুলিশ অভিযান চালিয়েছে, এতে ১২০ জন সদস্য অংশ নিয়েছেন, তবে প্রথম দিন কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার সম্ভব হয়নি। তবে পুলিশ বলছে, এই অভিযান চলবে এবং অপরাধ উপড়ে ফেলার জন্য যেকোনো উদ্যোগ নেওয়া হবে। পুলিশ কর্মকর্তা ফয়সাল মাহমুদ বলেছেন, ‘এই অভিযান রাতেও চলবে। কেন্দ্রের এশে শুধু নয়, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা ও স্বস্তি ফেরানোর জন্য এই পদক্ষেপ।’ সচেতনতা ও আতঙ্কজনক পরিস্থিতি কাটিয়ে জনগণের মাঝে স্বস্তি ফিরতে এখনও সময় লাগবে বলে মনে করেন অন্যরা।

পোস্টটি শেয়ার করুন