বুধবার, ৫ই নভেম্বর, ২০২৫, ২০শে কার্তিক, ১৪৩২

হাওরাঞ্চলে হাঁসের খামার বদলে দিচ্ছে অর্থনৈতিক চিত্র

কিশোরগঞ্জ জেলার নিকলী উপজেলার ঘোড়াউত্রা নদীর দু পাশে লক্ষাধিক হাঁসের খামার দৃশ্যमान। বাঁশের খুঁটি ও জালের দিয়ে ঘেরা এসব অস্থায়ী পুকুরে সারাদিন দেশি প্রজাতির হাঁসরা সাঁতার কাটে। রাতে তারা নদীর ধারে নির্মিত ছোট ছোট ঘরে বিশ্রাম নেয়। খামারিরা বলছেন, কম পুঁজিতেই সহজলভ্য প্রাকৃতিক খাদ্য যেমন শামুক ও ঝিনুকের সাহায্যে এই শিল্পে লাভের সুযোগ তৈরি হচ্ছে, যাতে অনেকের জীবনধারা বদলাচ্ছে।

এছাড়া, নিকলী ছাড়াও ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম ও তাড়াইল এর মতো হাওরঘেরা উপজেলা গুলোতেও বর্ষায় হাঁসের চাষের প্রবণতা দ্রুত বেড়ে চলেছে। এতে অর্থনৈতিক উন্নতি ও নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে।

জেলার প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও স্থানীয় সূত্র থেকে জানা গেছে, কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলে বছরে প্রায় দুই কোটি হাঁসের ডিম উৎপাদিত হয়। জেলার চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি, দেশের মোট ডিমের প্রায় ২৫ শতাংশ এখানে উৎপন্ন হয়। এই ডিম ঢাকাসহ চট্টগ্রাম, সিলেট ও অন্যান্য বড় শহরে সরবরাহ হয়। পাশাপাশি হাঁসের মাংসও দেশে বেশ জনপ্রিয়।

তাড়াইলের দামিহা এলাকায় গড়ে উঠেছে শতাধিক হাঁসের hatchery, যেখানে প্রতিদিন প্রায় দুই লাখ থেকে আড়াই লাখ হাঁসের বাচ্চা উৎপাদিত হয়। এগুলি দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয়।

খামারি আলমগীর হোসেন বলেন, ‘ভাসান পানিতে খামার করলে বেশি জায়গার প্রয়োজন হয় না। জাল ও বাঁশের পুল দিয়ে হাঁস ছেড়ে দিই, শামুক ও দানাদার খাবার দিয়ে চাইলে চাহিদা পূরণ হয়। খরচ কম হওয়ায় মৌসুমে ভালো লাভ হয়।’

মিঠামইনের রাবেয়া খাতুন বলেন, ‘আমাদের ডিম সরাসরি পাইকাররা নিয়ে যায় ঢাকা, চট্টগ্রাম। তবে হাঁসের রোগ হলে দ্রুত চিকিৎসা না পাওয়া গেলে ক্ষতি হয়। মোবাইল ভেটেরিনা টিম থাকলে অনেক সমস্যা কমে আসত।’

তাড়াইলের শাহাদত হোসেন বলেন, ‘দামিহায় এখন অনেক hatchery হয়েছে। আমরা প্রতিদিন হাজার হাজার হাঁসের বাচ্চা তুলতে পারি। যদি বিদ্যুৎ ব্যবস্থা স্থায়ী হয় এবং একটি কেন্দ্রীয় সংগ্রহস্থল হয়, তবে বড় স্কেলে এর কাজ সম্ভব।’

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা বলছেন, ‘হাওর এলাকার ভাসান পানির হাঁসের মাংস ও ডিম স্বাতন্ত্র্যপূর্ণ, সুস্বাদু ও পুষ্টিকর। তাই এর চাহিদা সবসময় থাকে।’ তিনি আরও জানান, এই সম্ভাবনাময় খাতের উন্নয়নে প্রশিক্ষণ, টিকা ও পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

বর্তমানে কিশোরগঞ্জে প্রায় ২ হাজার হাঁসের খামার রয়েছে, যেখানে প্রায় ২৫ লাখ হাঁস লালনপালন হয়। খামারির সংখ্যা প্রায় ১৫০০, আর এ খাতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত প্রায় ১২ হাজার পরিবার। বছরে প্রায় দুই কোটি ডিম উৎপাদিত হয়।

খামারীরা বলেন, হাঁসের রোগ-বালাই দেখা দিলে দ্রুত ভেটেরিনারি সহায়তা প্রয়োজন। তারা চাই মোবাইল ভেট সার্ভিস, টিকা, ঔষধ, স্বল্পসুদে ঋণ, ফিড ও ডিমের সংগ্রহের কেন্দ্র, এবং ন্যায্য মূল্য নিশ্চয়তা।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ও বাজারসংযোগ বাড়লে শুধুমাত্র স্থানীয় পর্যায়েই সীমাবদ্ধ থাকবে না, এটি দেশের বৃহৎ অর্থনৈতিক খাতে রূপ নিতে পারে, যা বাংলার অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম।

পোস্টটি শেয়ার করুন