দেশে প্রথমবারের মতো নতুন ধরনের সিনথেটিক মাদক এমডিএমবি (মেটামফেটামিন ডাইএথাইলামাইনে) এর চালান জব্দ করা হয়েছে। ঢাকার মিরপুরের আশরাফুল ইসলাম একাধিক উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্যের মধ্যে এই মারাত্মক মাদক সরবরাহ করতেন বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে। তিনি মূলত ভেপ ডিভাইস ব্যবহারকারীদের লক্ষ্য করে এই মাদকের বিক্রির জন্য অনলাইন মার্কেট গড়ে তুলছিলেন। এ ঘটনায় তার সঙ্গে অভিযানে সংশ্লিষ্ট চক্রের চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যারা মালয়েশিয়া থেকে এই মাদক এনে দেশে পৌঁছানোর সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
শুক্রবার (১২ ডিসেম্বর) সকালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর তাদের প্রধান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানান মহাপরিচালক মো. হাসান মারুফ। তিনি বলেন, তরুণদের মধ্যে ই-সিগারেট ও ভেপের ব্যবহার উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। এই ডিভাইসগুলোতে সাধারণত নিকোটিন বা তামাকজাতীয় পদার্থ থাকলেও সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে নতুন ও বিপজ্জনক সাইকোঅ্যাকটিভ পদার্থ (এনপিএস), ওপিয়য়েডস, এবং এমডিএমবি মিশ্রিত হওয়ায় মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি হচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী মাদক конт্রোল সংস্থা (আইএনসিবি) ‘অপারেশন ই-ভেপর৮’ নামে এক অপারেশন চালু করে এসব বিপজ্জনক ডিভাইসের মাধ্যমে ছড়াচ্ছে এমন মাদক নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। এর অংশ হিসেবে, বাংলাদেশেও ডিএনসির গোয়েন্দা দল ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া ও ডার্ক ওয়েবে নজরদারি চালিয়ে এ মাদক চক্রের বাস্তব চিত্র উন্মোচন করে।
তাদের জিজ্ঞাসাবাদে উঠে আসে, মালয়েশিয়া গিয়ে তারা সেখান থেকে মাদক সংগ্রহ করে দেশে ফিরতেন। তারা মূলত খন্দকার তৌকিরুল কবির তামিম (২৬), মেহেদী হাসান রাকিব (২৬), মাসুম মাসফিকুর রহমান বা সাহস (২৭), এবং আশরাফুল ইসলাম (২৫)—এই চারজন। তাদের কাছ থেকে ৩৪০ মিলিলিটার এমডিএমবি, সিবিডি মিশ্রিত গাঁজার চকলেট, ভেপ ডিভাইস ও ই-লিকুইডসহ বিভিন্ন মাদক অঙ্কিত দ্রব্য জব্দ করা হয়।
অভিযোগ অনুযায়ী, এ চক্রটি ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপের ভুয়া গ্রুপ এবং রিভিউ পেজের মাধ্যমে গোপনে ঝুঁকিপূর্ণ এই মাদক সরবরাহ করত। তারা ইনবক্স মেসেজ, অ্যান্ড-টু-অ্যান্ড এনক্রিপ্টেড চ্যাট, লোকে দেখানো না হয় এমন লুকোচুরি করে অপারেট করত। লোকেশন শেয়ার, লাইভ ট্র্যাকিং ও বিশেষ ইমোজির মাধ্যমে লেনদেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতো।
প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, ওই চক্রের এক সদস্য তামিমকে প্রধান কারবারি হিসেবে শনাক্ত করে তার কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। ১০ ডিসেম্বর মিরপুর পল্লবীর একটি ভেপ শপে অভিযান চালিয়ে ২০ মিলি এমডিএমবি সহ তামিমকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর, জিজ্ঞাসাবাদ ও প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণে তার অবস্থান নিশ্চিত হয় এবং তাকে আরও কিছু এমডিএমবি ও অন্যান্য দ্রব্যের সঙ্গে গ্রেপ্তার করেন।
তাদের স্বীকারোক্তি ও তদন্তে জানা যায়, দেশে এই মাদক সরবরাহকারী একটি বিশাল নেটওয়ার্ক সক্রিয় রয়েছে। এই সময়, আশরাফুল ও সাহস নামের দুইজনকে আরও বেশি এমডিএমবি সহ বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয়।
এমডিএমবি অত্যন্ত ক্ষতিকারক এক তরল সিনথেটিক মাদক, যা মাত্র কয়েক ফোঁটা স্নায়ুতন্ত্রের মারাত্মক ক্ষতি করে। ভেপ ডিভাইসের মাধ্যমে এটি ব্যবহারে দ্রুত আসক্তি তৈরি হয় এবং হ্যালুসিনেশন, আক্রমণাত্মক আচরণ, এমনকি হৃৎস্পন্দনের অস্বাভাবিকতা দেখা দিতে পারে। দেখতে সাধারণ ফ্লেভারড লিকুইডের মতো থাকায় শনাক্ত করা কঠিন, যা ব্যবহারে বুঝতেও পারে না। এই মাদকের সাথে অল্প পরিমাণে মিশিয়ে নিকোটিনযুক্ত লিকুইড ব্যবহৃত হয়।
চক্রটি অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ‘অদৃশ্য বাজার’ তৈরি করতো, যেখানে তারা গোপনে দাম নির্ধারণ ও সরবরাহ নিশ্চিত করত। এসব প্ল্যাটফর্মে তারা লোকেশন শেয়ার, লাইভ ট্র্যাকিং ও ইমোজির মাধ্যমে লেনদেন সম্পন্ন করত।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে অনেক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নাম উঠে এসেছে, এবং তাদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা তদন্ত চলছে। সব অভিযানে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের আওতায় মামলা দায়ের করা হয়েছে।
ডিএনসিবি জানিয়েছে, ভবিষ্যতেও এ ধরনের অভিযান চালানো হবে এবং ভেপের মাধ্যমে ছড়ানো এই ধরনের মাদক প্রতিরোধে রাজধানীর ভেপ শপগুলোর ওপর নজরদারি বাড়ানো হবে।





